মূল্যবোধ অর্জন ও জ্ঞানের চর্চা বাড়ানোই সেন্ট যোসেফের লক্ষ্য: প্রিন্সিপ্যাল ব্রাদার লিও 

প্রায় ৭০ বছর ধরে বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার শিক্ষাঙ্গন আলোকিত করে রেখেছে সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। রাজধানীর আসাদ এভিনিউয়ের স্কুল প্রাঙ্গনটি বছরজুড়েই থাকে শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মুখরিত। দীর্ঘ সময় ধরে মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমেই অভিভাবক-শিক্ষার্থী-শিক্ষানুরাগীদের মাঝে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে স্কুলটি। এই সাফল্যের পেছনে একটি মূল কারণের কথা মনে করিয়ে দিলেন সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রিন্সিপ্যাল ব্রাদার লিও জেমস পেরেইরা। চলপড়ি’র সাথে আলাপকালে তিনি বলছিলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনকে প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত করার চেষ্টা করি আমরা। শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমসহ শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনও যেন সুশৃঙ্খল হয়ে ওঠে, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। আর এ কাজে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েরই অংশীদারিত্ব রয়েছে।’

ব্রাদার লিও জেমস পেরেইরা, প্রিন্সিপ্যাল, সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়

সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ২ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। কয়েকটি সেকশন ও দুটি শিফটে পরিচালিত স্কুলটিতে বাংলা ও ইংরেজি দুই মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হয়। প্রিন্সিপ্যাল ব্রাদার লিও এর ভাষায়, এই শিক্ষা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্যই হলো মূল্যবোধ অর্জন। ‘শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ ও জীবনভিত্তিক দক্ষতাগুলো অর্জনের দিকেই স্কুলের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। তারা যেন স্কুল পরবর্তী জীবনে সফল হতে পারে, সেজন্য জ্ঞানের চর্চা বাড়ানো এবং তা ধরে রাখার ওপর গুরুত্ব দিই আমরা।’ একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে স্কুলের ভূমিকাকেই সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী বলেও মনে করেন ব্রাদার লিও। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্কুলের পর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করলেও এর মূল ভিত্তি আর তার জীবনাচরণের বিষয়টি কিন্তু স্কুল পর্যায়েই বিকশিত হয়। এজন্য শিক্ষার্থীর জীবনে স্কুলের ভূমিকাকে প্রধানতম বলেই মনে করি আমি।’

ব্রাদার লিও এর মতে, বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন লেখাপড়া নিশ্চিতে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে অভিভাবক-শিক্ষকদের। সেল্ফ লার্নিং বা শিক্ষার্থীদের নিজে নিজে শেখার প্রবণতা কমে যাওয়াটা অন্যতম দুশ্চিন্তা হয়ে উঠছে। তিনি বলছিলেন, ‘মুখস্ত ও টিউশন-কোচিং এর মতো শিক্ষকনির্ভর পড়ালেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। এই জায়গাগুলোতে সংক্ষিপ্ত পড়া পড়ানো হচ্ছে, হয়তো শুধু পরীক্ষায় ভালো করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে শেখার জায়গায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।’ করোনা ভাইরাস সংক্রমের কারণে দীর্ঘদিন সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল বাংলাদেশে। এ সময় অন্যান্য অনেক স্কুলের মতো সেন্ট যোসেফও অনলাইন ক্লাসের মতো সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছে। সেসময় ও বর্তমানে পাঠদানের কাজে বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস গুরুত্বপূর্ণ হলেও ব্রাদার লিও এর মতে, এই প্রয়োজনীতাটিই এখন অনেক ক্ষেত্রে ডিভাইস আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রায়ই অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানের ডিভাইস আসক্তির সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করেন। আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে আমাদের কাউন্সেলিং টিমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ডিভাইসগুলো পড়ালেখার কাজে নির্দিষ্ট সময় মেনে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকি।’ তবে অতিরিক্ত ব্যবহারের শঙ্কা থাকলেও ডিভাইস ব্যবহার করে বিভিন্ন শিক্ষামূলক কন্টেন্ট শিশুদের পড়ালেখায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। 

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার নানা রকম পথ আছে বলে মনে করেন ব্রাদার লিও জেমস পেরেইরা। শিক্ষার্থীদের মুখস্ত নির্ভরতা কমাতে তাঁর পরামর্শ, সহশিক্ষা কার্যক্রম ও ব্যবহারিক ক্লাসের পরিমাণ আরও বাড়ানো। এতে শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারবে, যা তাদের মুখস্তনির্ভর পড়ালেখা থেকে দূরে রাখবে। সেন্ট যোসেফ স্কুলও এজন্য এর শিক্ষার্থীদের এমন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত রাখছে। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সুযোগ ছাড়াও স্কুলের ক্লাব সংস্কৃতি খুবই শক্তিশালী। ডিবেট, সায়েন্স, ড্রামা, দাবা, রিডিং, বিজনেস ক্লাবের মতো সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত সেন্ট যোসেফের শিক্ষার্থীরা। স্কুলে আছে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরিও। মুখস্ত নির্ভরতা কমাতে আরও একটি পদ্ধতি খুবই কার্যকর হতে পারে বলে মনে করেন ব্রাদার লিও। তিনি বলেন, ‘নিয়মিত অ্যাসেসমেন্ট বা শিক্ষার্থীর শেখার পরিমাণ যাচাই করার মাধ্যমে তার  মুখস্ত নির্ভরতার ইতি টানা যেতে পারে। আমরা প্রতি সপ্তাহেই ক্লাস অনুযায়ী একাধিক ক্লাস টেস্টের ব্যবস্থা করি। এতে শিক্ষার্থীরা একটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করে, তাদের প্রতিদিন ক্লাসে শেখার আগ্রহও বাড়ে।’   

ব্রাদার লিও জেমস পেরেইরার মতে, সঠিক নিয়মে অভিভাবক কিংবা শিক্ষকের পর্যবেক্ষণে ডিজিটাল টুলস্‌ ব্যবহার করে শিক্ষাদান এখন যুগের চাহিদা। সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭০% ক্লাসরুমই এখন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে পরিণত হয়েছে। সেখানে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ডিজিটাল টুলস্‌ ব্যবহার করছেন। বর্তমানে নতুন পাঠ্যক্রমের চাহিদা অনুযায়ীও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বাড়ছে। ব্রাদার লিও বলেন, ‘বর্তমান সময় ডিজিটাল ডিভাইসের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করলে হবে না। তাই এটাকে বাদ না দিয়ে বরং শিশুকে শেখাতে হবে, কীভাবে এই ডিভাইস ও টুলগুলো সঠিকভাবে নিজেদের আত্মোন্নয়নে ব্যবহার করা যায়। শিশুরা দিনের কতক্ষণ ডিভাইস ব্যবহার করবে, সে সময় তারা কী দেখবে, এই বিষয়গুলো অভিভাবক ও শিক্ষকদের নজর রাখতে হবে।’ 

একজন শিক্ষার্থীর সফল শিক্ষাজীবনে স্কুল ও শিক্ষকের সাথে অভিভাবকের প্রধানতম ভূমিকার কথা স্বীকার করে সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এজন্য প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে অভিভাবকদের সাথে স্কুলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। ব্রাদার লিও বলেন, ‘স্কুলের গভর্নিং বডিতে অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্ব আছে। সেখান থেকে আমরা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তার  কথা জানতে পারি। এছাড়াও আমার সাথে সরাসরি অভিভাবকদের যোগাযোগের সুযোগ আছে। সন্তানদের যেকোনো বিষয়ে তাঁরা পরামর্শের জন্য আমার কাছে আসতে পারেন।’ 

আলাপের একদম শেষ পর্যায়ে প্রিন্সিপ্যাল ব্রাদার লিও এর কাছে চলপড়ি জানতে চেয়েছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক সম্পর্কে। উত্তরে ব্রাদার লিও জানান, শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন ধাপ মিলিয়ে তাঁর একাধিক প্রিয় শিক্ষক আছে। একদম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রিয় শিক্ষক ছিলেন শেফালী ডি কস্টা ম্যাম। পরবর্তীতে হাইস্কুলে তাঁর প্রিয় হয়ে ওঠেন ইংরেজির শিক্ষক মোড়ল স্যার। আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ার সময় তাঁর প্রিয় হয়ে ওঠেন মানিক স্যার। মজার বিষয় হলো, এত এত শিক্ষকের মাঝে ব্রাদার লিও এর কাছে এই তিনজনের প্রিয় ওঠার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাঁদের প্রত্যেকেই শিক্ষার্থী হিসেবে আমার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। যেকোনো সমস্যা বা যেকোনো সময় তাঁদের কাছে যেতে পারতাম আমি। আমার মনে হয় এটিই তাঁদের আমার কাছে স্মরণীয় করে রেখেছে।’  

Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *