ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সাথে কথোপকথনে

নিজের জীবনের হিরোদের সাথে নাকি দেখা করতে নেই! কখনো দেখা হয়ে গেলেও তথ্যটা তাঁদের না জানাই ভালো। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাথে কথা বলার সময় আমার কানে ঠিক এই কথাগুলোই বাজছিল। তবে ওটা আমার জ্বরের কারণেও মনে হতে পারে, নিশ্চিত বলতে পারবো না। ড. জাফর ইকবালের সাথে আমাদের আলাপচারিতার উপলক্ষ্যটা সামান্য। কিছুদিন আগেই চলপড়ি রংবেরঙের ছবিসহ তাঁর দুইটি ছোটগল্প প্রকাশ করেছে—‘আমড়া ও ক্র্যাব নেবুলা’ আর ‘একটি কুৎসিত প্রাণী’। কথা শুরু করার জন্য এই প্রসঙ্গটাই উপযুক্ত। ভিডিও কলে যুক্ত থাকায় আমার কিছুটা নির্ভারও লাগছিল। কিন্তু প্রায় ৪০ মিনিট যাওয়ার পর আমার মনে হলো, ছোটগল্পের আলাপ তো দূরে থাক, আমি তাঁকে নিজের পরিচয়ই দিইনি, সাথে থাকা আমার সহকর্মীর সাথেও তাঁর পরিচয় করাইনি। আমি নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। কোনোরকমে আলাপটা শেষ করে উঠতেই সহকর্মী সাদিয়া জানালো, পুরোটা সময় নাকি আমাকেই সেলিব্রেটি মনে হয়েছে। কী যা-তা একটা অবস্থা!

ড. মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল

কোথায় যেন শুনেছিলাম, ড. জাফর ইকবাল নাকি একটু রাশভারী মানুষ। কিন্তু আমার অমন মনেই হয়নি। বরং আমার উলটাপালটা সব প্রশ্নের উত্তর উনি বেশ আনন্দ নিয়েই দিচ্ছিলেন। ভিডিও ফুটেজ দেখলে নিশ্চিত এটাই মনে হবে। এই যেমন হঠাৎ করে আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি সিলেটে কেন থাকেন?’ প্রশ্নটা এমনভাবে করেছি, যে কেউ শুনলেই ভাববে, উনি বোধহয় বিশাল কোনো অপরাধ করেছেন! কিন্তু উনি শুধু একটু অবাক হলেন। এখানে বলে রাখি, আমার প্রশ্নের সাথে সিলেটের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আসলে জানতে চাচ্ছিলাম, আমেরিকায় গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার পরও কেন তিনি আর তাঁর ভাই, বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদ দেশে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করলেন? তিনি বেশ সহজেই উত্তরটা দিলেন।

‘এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের দুজনের ক্ষেত্রেই এক। এটা আমার দেশ, আর নিজ দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচার মতো শান্তি দুনিয়ার আর কোথাও নেই। প্রথমদিকে কিছু সমস্যা ছিল। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় তখন মাত্রই খুলেছে, হাতেগোনা কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক। তবে এটাই ভালো হলো। তরুণ শিক্ষকদের সাথে মিলে নিজের মনের মতো সব ঠিক করলাম, ছাত্রছাত্রীদের কী পড়াবো, না পড়াবো। ওই সময়টা প্রাণভরে উপভোগ করেছি।’

হাস্যোজ্জ্বল ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

অবশ্য তিনি কোথায় থাকছেন বা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তাঁর অবদান নিয়ে শুনতে আমি অতটা আগ্রহী ছিলাম না। এই আলাপচারিতায় আমার আগ্রহের প্রধান কারণ, তিনি কেন লেখেন, কীভাবে লেখেন—এই প্রশ্নের উত্তর জানা।

‘কেন লিখতে শুরু করলাম, এর কোনো নির্দিষ্ট কারণ আমি বলতে পারবো না। আসলে আমার লেখা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। আমার বাবা প্রচুর বই পড়তেন। আমাদের বাসা ভর্তি ছিল তাঁর সব বই দিয়ে। আমরা সেগুলো পড়তাম, কারণ পড়া ছাড়া বিনোদনের জন্য আর কোনো কিছু ছিলও না তখন। আর যদি তুমি পড়তে থাকো, নিশ্চিত তুমি একদিন লিখতেও চাইবে। আমাদের সাথেও ঠিক তা-ই হলো। আমরা লিখতে শুরু করলাম, যেন এটাই হওয়ার ছিল। আমরা কিন্তু লেখক হতে লেখা শুরু করিনি। কিন্তু জানতাম, শুরু যখন করেছি, কিছু না কিছু একটা তো লিখবোই।’

ড. জাফর ইকবাল বিষয়টা যতটা সহজে বোঝালেন, লেখার কাজটা কিন্তু ততটা সহজ না। এই ব্লগটার কথাই ধরুন, আমার রীতিমতো ঘাম ছুটছে। আমি তাঁর সহজ ব্যাখ্যায় অতটা সন্তুষ্ট হতে পারলাম না, আমি তাঁর লেখার পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে আরও বুঝতে চাইলাম।

‘আমাদের কাছে লেখাকে কঠিন কিছু মনে হয়নি। লিখতে তো শুধু কলম আর কাগজই দরকার। আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। আমি লিখি, আমাদের ছোট ভাইও লেখে, বাবা লিখতেন, আবার মাও লিখতেন। নিয়মিত লেখালেখি করা আমাদের পরিবারে প্রতিদিনের একটা ঘটনা ছিল। আমরা কখনো ভাবতেও পারিনি, একদিন মানুষ আমাদের লেখক হিসেবে জানবে। আমি বিজ্ঞানের মানুষ, এখনো নিজেকে সেভাবেই দেখি। লেখক হওয়া আমার জন্য একটা বাড়তি পাওনা। ভাবলে আমি এখনো আশ্চর্য হয়ে যাই।’

ড. জাফর ইকবালের লেখা ‘একটি কুৎসিত প্রাণী’ গল্পের একটি পাতা। পুরো বই অনলাইনে পড়ুন চলপড়ি-তে!

‘আপনি লেখালেখিটাকে সিরিয়াসলি নেওয়া শুরু করলেন কবে থেকে?’
‘১৯৭১ এর পর থেকে। তখন শুধু ‘বিচিত্রা’ নামে একটা ম্যাগাজিন গল্প প্রকাশ করতো। সেই ম্যাগাজিনে যদি কারও একটা গল্প প্রকাশ পায়, পুরো দেশজুড়ে উদীয়মান লেখক হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়তো। ‘ছেলেমানুষি’ নামে আমার প্রথম গল্প এই বিচিত্রাতেই প্রকাশ পেলো। এরপর আমার আরও অনেক লেখাই ছেপেছে ওরা। কিন্তু আমার প্রথম প্রকাশিত বই হলো ‘হাতকাটা রবিন’। ওটার পাণ্ডুলিপি শেষ করেই আমি প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। উনি পড়ে বললেন, বাচ্চাদের জন্য বইটা নাকি বেশ বড়। তাই আমাকে তিন ভাগের এক ভাগ লেখা ফেলে দিতে হলো।’

উনি আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, আমি বাধ সাধলাম। ‘কোনগুলো ফেলে দিলেন? ফুটবল টুর্নামেন্টের আগে, নাকি পরে?’ বলে রাখি, ‘হাতকাটা রবিন’ আমার এতটাই পছন্দের একটা বই যে, এর পুরোটা আমার প্রায় মুখস্থ। ‘সম্ভবত পরে,’ ছোট্ট হেসে জবাব দিলেন তিনি। 
আমি আরও বিস্তারিত জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার ঠিক বিপরীতে ওয়েব ক্যামের সীমানার বাইরে বসে থাকা আমার লাইন ম্যানেজারের শীতল দৃষ্টিতে থামতে বাধ্য হলাম। গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয়ে এখনো কথা বলা বাকি। এনসিটিবির নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ড. জাফর ইকবাল। এটি আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে সরাসরি জানতে চাইলাম তাঁর কাছে। নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পর থেকেই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন দেখা গিয়েছে অভিভাবকদের। কারণ নতুন এই পদ্ধতিতে প্রচলিত পরীক্ষা আর গ্রেডিং সিস্টেম অনেকটাই বাতিল হয়ে গিয়েছে। অভিভাবকরা তাহলে বুঝবেন কীভাবে, তাদের সন্তানেরা কতটা শিখছে?

‘ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কথা মাথায় রেখেই নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে। মুখস্থবিদ্যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা আর বিশ্লেষণী দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবার সাথে মিলে কাজ করা আর কোনো সমস্যার একাধিক সমাধান খুঁজে বের করার মানসিকতা তৈরির দিকে বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছে। আগে শুধু একটা উত্তরই সঠিক ছিল, আর সেটাও আমাদের দেখতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় এভাবে কাজ হয় না। সেখানে আমাদের অনেককে একসাথে কাজ করতে হয়, একটা সমস্যার সমাধান অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। নতুন শিক্ষাক্রম শিশুদের যেকোনো কিছুকে প্রশ্ন করতে ও একসাথে কাজ করতে শেখাবে। আর বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এটাই বেশি প্রয়োজন।’

‘কিন্তু শিশু কী শিখছে, তা এই ব্যবস্থায় আমরা বুঝবো কীভাবে?’
‘খুব সহজে। আমরা তাদের বিভিন্ন সৃজনশীল প্রশ্ন করবো। তারা কীভাবে সেটার উত্তর দেয়, কীভাবে নিজেদের উত্তরের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে, তার ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হবে।’

ড. জাফর ইকবালের লেখা ‘আমড়া ও ক্র্যাব নেবুলা’ গল্পের একটি পাতা। পুরো বই অনলাইনে পড়ুন চলপড়ি-তে!

এমন উত্তরের পর আমরা স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের কথায় ফিরে এলাম। বর্তমান প্রযুক্তিভিত্তিক দুনিয়ায় বই এখনো কতটা প্রাসঙ্গিক?
‘কেউ যখন বই পড়ে, তখন কিন্তু দারুণ একটা ম্যাজিক ঘটে। সাদা পৃষ্ঠার ওপর তুমি কালো কালিতে আঁকা কিছু চিহ্ন দেখছো, আর তোমার মস্তিষ্ক সেই চিহ্নগুলোকে ছবিতে, চরিত্রে রূপান্তরিত করছে। একটা অন্যরকম অনুভূতি তখন আমাদের মধ্যে কাজ করে। এই অন্যরকম বিষয়টা মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য খুবই জরুরি। বই পড়ার সময় তুমি একই সাথে চিন্তা ও কল্পনা করছো। একটা শিশু যদি এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না যায়, তাহলে কী দুর্দান্ত একটা বিষয় তার অজানাই থেকে গেল! অথচ এই অভিজ্ঞতাটাই আমাদের মানুষ হিসেবে পরিচিত করেছে। পৃথিবীতে অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, কিন্তু শুধু আমরাই এমন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে পারি, চিহ্ন ও মন্তাজ থেকে অর্থ বের করতে পারি। বই আমাদের যেকোনো কিছুর গভীরে যেতে সাহায্য করে। ভিডিও কিংবা সিনেমায় এটা সম্ভব নয়। সেখানে তুমি শুধু একজন নিষ্ক্রিয় দর্শক, তোমাকে যা দিচ্ছে, তা-ই গিলছো। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি মানুষ হিসেবে এমন একটা অভাবনীয় দক্ষতা নিয়ে জন্ম নিই, তাহলে পৃথিবীর প্রতি আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমাদের আরও সহানুভূতিশীল হওয়া ও ভালো কিছু করার চেষ্টা করা উচিত। দিনের পর দিন শুধু অন্যের তৈরি করা কন্টেন্ট গিললেই আমাদের চলবে না।’

আমি একমত না হয়ে পারলাম না। স্বীকার করে নিলাম, এই দোষে আমি নিজেও দুষ্ট। আমি ক্লান্ত থাকলে আমার দুই বছর বয়সী ছেলের হাতে কার্টুন দেখার জন্য মাঝে মাঝেই মোবাইল তুলে দিই। ও খেতে না চাইলেও একই কাজ করি। কিন্তু একটানা বেশ কিছুক্ষণ দেখলেই ওর আচরণে স্পষ্ট  কিছু পরিবর্তন দেখেছি আমি। এসময় ও অন্য কিছু শুনতে চায় না, কেমন খিটখিটেও হয়ে যায়।

ছোটদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

ড. জাফর ইকবাল সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন। নিজেকে বাঁচাতে আমি দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেললাম। উনাকে জানালাম, আমার অসমাপ্ত গল্পের (এটার স্ট্যাটাস সবসময়ই অসমাপ্ত) প্রধান চরিত্রটি তাঁর ‘হাতকাতা রবিন’ এর রবিন চরিত্রটি থেকে প্রচণ্ড মাত্রায় অনুপ্রাণিত। আশা করছিলাম, প্রসঙ্গ পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ফাঁকে এ ব্যাপারে তাঁর সম্মতিটুকুও নিয়ে ফেলবো।
আমার কথা শুনে তিনি হাসলেন। বললেন, ‘এটা তো ভালো কথা। কোনো কিছু পড়ার পর সেটা থেকে কিছু বিষয় চুরি করতে যদি তোমার মন না চায়, তাহলে তো ওই লেখক ব্যর্থ।’

মেধাস্বত্ব আইনে মামলার ভয় কাটিয়ে আমাদের আলাপ শুরু এক ঘণ্টা পরে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। কম্পিউটার মনিটরের পেছনে থাকার কারণে যাদের এতক্ষণ ড. ইকবাল দেখতে পাননি, তাদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলাম। এই পরিচয় পর্বের মাঝখানেই আমাদের জুম মিটিং এর সময় শেষ হয়ে গেল।

এই তো। এভাবেই শেষ হলো লেখক, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ আর আমাদের সবার অনুপ্রেরণা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাথে একটা সুন্দর আলোচনা। অন্তত আমার কাছে আলোচনা পর্বটা ভালোই লেগেছে। কিন্তু সাদিয়া মানতে নারাজ। বলছে, আমি নাকি জঘন্য ছিলাম। কিন্তু আমার জন্য এই ব্লগটা কে পড়তে আসবে! ড. জাফর ইকবাল সবসময়ের মতোই ছিলেন দুর্দান্ত আর ওটাই পড়বে সবাই। আমি বরং আস্তে-ধীরে তাঁর বই থেকে আরও কিছু চরিত্র চুরি (শব্দটা পড়তে হবে অনুপ্রাণিত) করে ফেলি। এখন তো উনি অনুমতিও দিয়ে গিয়েছেন!

সালজার রহমানের লেখা ইংরেজি ব্লগ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন সিজান আহমেদ।

Authors

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *